থিমের মোহে শক্তি আরাধনা — ম্লান হচ্ছে না তো শহরের নিজস্বতা?
ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
দীপান্বিতা অমাবস্যা মানেই বাঙালির মনে এক অন্যরকম আবেগ। দুর্গোৎসবের পরেই আসে বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুজো — কালীপুজো। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে নিশীথরাত্রে মহাশক্তির আরাধনায় মেতে ওঠেন আপামর বাঙালি। দুই দিন ধরে চলে আলো, শব্দ, ও শক্তির উৎসব। তবে শারদোৎসবের মতোই এই দীপান্বিতা কালীপুজোও আজ হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। আর সেই সার্বজনীনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে থিমের আমেজ। গোটা রাজ্য জুড়ে এখন থিমের কালীপুজো — কখনও ঐতিহ্য, কখনও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভরপুর। উত্তরবঙ্গও বাদ নেই সেই স্রোতে। শিলিগুড়ির বিভিন্ন পুজো উদ্যোক্তারা এ বছরও নানান ধরণের থিমে দেবী আরাধনায় মেতেছেন।
তবে এ বছর শহরের কালীপুজোয় এক নতুন প্রবণতা নজরে এসেছে। দক্ষিণবঙ্গের প্রাচীন শক্তিপুজোর রীতি-নীতি ও সংস্কৃতির অনুকরণ। এই যেমন নৈহাটির বিখ্যাত ২১ ফুটের “বড়মা” পর্যন্ত — অনুকরণের ছায়া পড়েছে শিলিগুড়ির দুটি পুজো মণ্ডপে। কোথাও আবার শান্তিপুরের বামাকালীর শেষ গায়ের রোম দাঁড় করিয়ে দেওয়া নৃত্যের অনুকরণ। অবশ্য আপাত দৃষ্টিতে এই অনুকরণে তেমন কোনো ভুল নেই বলেই মনে করেন অনেকে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই একাংশ নেটিজেনের প্রশ্ন— “থিমের বাহার আর অনুকরণের মোহে কি তবে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি হারাচ্ছে নিজের স্বকীয়তা? মহাশক্তির আরাধনা কী কেবল অনুসরণের উৎসবে পরিণত হচ্ছে?”
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শিলিগুড়ি মহাবিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তথা নাট্যব্যক্তিত্ব ও বাচিক শিল্পী ডঃ অমিতাভ কাঞ্জিলাল তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, “অনুকরণে নয়, ভক্তিতেই হোক আরাধনা”— কালীপুজোর থিম-উন্মাদনা নিয়ে গভীর ভাবনা।
“প্রথমেই যে বিষয়টি আমাকে ভাবায়, তা হল মেধা! অনুকরণ বা অনুসরণ মানেই তো নিম্ন মেধা। সেখানে স্বকীয়তা বা নিজস্বতা স্বভাবতই হারিয়ে যায়,”— এমনই মন্তব্য এক বিশিষ্ট সংস্কৃতিমনা নাগরিকের।
তিনি বলেন, “ভাবুন তো, এখান থেকে ওখান থেকে তুলে এনে আমরা ঠিক কতটা প্রেক্ষিতটাকে তুলে ধরতে পারছি? প্রশ্ন থেকেই যায়। নৈহাটির ‘বড়মা’ যে প্রেক্ষিতে, যে উপাচারে, যে ভক্তিধারায় প্রতিষ্ঠিত, তার কতটা আমরা উত্তরবঙ্গে অনুসরণ করতে পারি? শুধু মূর্তির উচ্চতা ২১ ফুট রাখলেই তো হবে না! এটা অনেকটা এমন, যেন পাহাড় থেকে একটা গাছ তুলে এনে মরুভূমিতে পুঁতে তাকে বাঁচানোর লড়াই করা— প্রকৃত ভক্তি ও প্রেক্ষিত দুটোই সেখানে হারিয়ে যায়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এই অ্যাসেম্বলিং-এর একটা ফ্যাশন তৈরি হয়েছে আজকাল। হয়তো এতে কিছুটা ট্যুরিস্ট ভ্যালু আছে, কিন্তু ভক্তি হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। যদি সত্যিই পুজোর মূল লক্ষ্য ভক্তি হয়, তাহলে এই দেখনদারি বন্ধ হোক, অপচেষ্টা বন্ধ হোক। স্বকীয়তা বজায় রেখে, আন্তরিক ভক্তির সঙ্গে পুজো ফিরে আসুক তার নিজস্ব মহিমায়— সেটাই অধিকাংশ মানুষের কামনা।”
ভক্তি ও থিমের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “যবে থেকে পুজোর সঙ্গে থিমের সংমিশ্রণ ঘটেছে, তবে থেকেই কার্যত ভক্তি ও সার্বজনীন রুচির সঙ্গে একপ্রকার প্রতারণা শুরু হয়েছে। আগে সার্বজনীন পুজো মানেই ছিল সকলের অংশগ্রহণ, একাত্মতা। কিন্তু এখন থিম আসাতে সেই অংশগ্রহণ হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আপনি দেখুন না, বড় বাজেটের পুজো মণ্ডপে ঢুকলেই দেখা যায়— দু’মিনিটও দাঁড়াতে দেওয়া হয় না। বাঁশি মেরে বলে দেয়, ‘চলুন, চলুন এগিয়ে যান’। এত খরচ, এত আড়ম্বর— অথচ ভক্তি বা শান্তির ছোঁয়া কোথায়?”
তাঁর বক্তব্যে তাই একটাই বার্তা স্পষ্ট — “কালীপুজো হোক ভক্তির, নয় প্রদর্শনীর। অনুকরণ নয়, নিজস্বতাই হোক উত্তরবঙ্গের পুজোর আসল পরিচয়।”
একই সুর শোনা গেল শিলিগুড়ি বিদ্যাসাগর বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরাগ মিত্র বাবুর গলায়।
তাঁর কথায়, কলকাতার রঙিন প্যান্ডেলগুলোর ঝলক উত্তরের কাতরতা ঢাকতে পারে না— কারণ আজকের থিম কালই নতুন নামে ফুটে ওঠে উত্তরবঙ্গে। বাঙালির রক্তে উৎসব, শিল্পের ঐতিহ্যও গভীর। তবু আজ কলকাতার প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে, উত্তরবঙ্গের মৌলিক শিল্পীরা হারাচ্ছেন নিজেদের জায়গা। অনেকে বাধ্য হয়ে কলকাতার প্যান্ডেল কিনে আনছেন, কেউ কেউ মৌলিকত্ব ত্যাগ করে কাজ করছেন অন্যদের জন্য। শিল্পীরা বলছেন— ঘাটতি সাহস, পরিকাঠামো আর আর্ট কলেজের অভাবে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় যেখানে আর্ট কলেজ আছে, সেখানে উত্তরবঙ্গে একটিও নেই। ফলে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ঘাটতি পেশাদারিত্বে। থিমের বিপণনেও পিছিয়ে উত্তর। স্থানীয় শিল্পীদের প্রাপ্য সুযোগ মেলে না। ফলে দক্ষিণের বাজারে লাভের পাল্লা ভারী হয়েই চলেছে। “উত্তর বঞ্চিত”—এই আক্ষেপ তাই প্রতি বছরই যেন ফিরে আসে নতুন করে।
আচ্ছা, এবার আসি নবীন প্রজন্মের তরুণ তুর্কিদের কথায়। এই পুরো থিম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি—এসব নিয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? শিলিগুড়ির পূর্ব বিবেকানন্দপল্লীতে ‘রান্নাবাটি’ নামে এক ক্লাউড-কিচেন চালিয়ে ইতিমধ্যেই সকলকে চমকে দিয়েছেন সৌম্যদীপ সরকার। টেলিফোনে যোগাযোগ করলে, তাঁর ভাবনাও যেন একই সুরে বাঁধা।
সৌম্যদীপ বলেন,
“বর্তমান সময়টা পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়ার। রিলস্ বানানোর সময়, ভাইরাল হওয়ার সময়। যদি কোনও বিষয়কে হাইপ দিতে না পারো, তবে ‘বস্’, চলবে না! বড়মা বলো, বামাকালী বলো, আগমেশ্বরী বলো বা শান্তিপুর—এসবই এখন ভাইরাল কনটেন্ট, অস্বীকার করাই যায় না। মানুষ চায় এমন বিষয়, যা নিয়ে কথা বলা যায়, শেয়ার করা যায়।
এই প্রেক্ষিতে আমি দেখি, দুটো দিক সমান্তরালে চলছে—এক, যারা সত্যিকারের ভক্তিসহকারে পুজোয় বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে থিম হোক বা না হোক, কিছু যায় আসে না। আর দুই, যাঁদের কাছে পুজো মানেই ঘোরা, খাওয়া, ছবি তোলা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা। এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের কাছেই এখন থিমই মূল আকর্ষণ, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ভবিষ্যতেও সম্ভবত এই প্রবণতাই আরও বাড়বে।”
তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, থিমের আগমনের পর দুর্গাপুজোর জগতে এসেছে নতুন দিশা, শিল্পসৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে নবীন চিন্তাধারার ছোঁয়া। অনুকরণ হোক বা অনুসরণ—এই প্রবণতার মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হচ্ছে নতুনত্বের ধারাবাহিকতা। থিমের আড়ালেই হোক কিংবা অন্য মাধ্যমে, আজকের প্রজন্ম সৃষ্টিশীলতার নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আর এই ভাবনাকেও আমাদের সম্মান জানানো উচিত—এমনটাই মনে করেন শিলিগুড়ির বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ সন্দীপ সেনগুপ্ত।
তাঁর মতে, “মায়াপুরের মন্দির, ইসকন, দক্ষিণেশ্বর, মাদুরাই, তারাপীঠ বা আদ্যাপীঠ—এমন বহু বিখ্যাত ধর্মস্থানের আদলে পুজোর মণ্ডপ নির্মাণের প্রথা নতুন নয়। অনেক মানুষ নানা কারণে এই স্থানগুলিতে যেতে পারেন না। তাঁদের কাছে সেই স্থানের সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক আবহ পৌঁছে দেওয়াই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে উদ্যোক্তাদের। এর মধ্যে কোনো নেতিবাচকতা নেই—বরং নবীন শিল্পবোধ ও সংস্কৃতির এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটে এখানেই।
“বড়মা বা বামাকালীকে যখন থিমের আবহে আনা হয়, তখন কেউই দাবি করেন না যে নৈহাটির বা শান্তিপুরের সেই আসল প্রতিমাকেই এখানে পুজো করা হচ্ছে। বরং এই স্থানগুলির ঐতিহ্য, তাদের ইতিহাসের প্রতি যে মানুষের টান ও কৌতূহল, তা-ই আসলে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এই দেখার তীব্র ইচ্ছাই উদ্যোক্তাদের মনে কাজ করে, আর তাঁরা সার্বজনীন পুজোর মাধ্যমে সেই ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দেন। আমার মতে, এটি মোটেও ভুল নয়। বরং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই থিম পুজো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই পুজো বহু মানুষকে জীবিকার সুযোগ দেয়। কারণ, থিম পুজো কৌতূহল জাগায়, দর্শনার্থীর আকর্ষণ বাড়ায়, আর সেই সঙ্গে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।”
ডাঃ সেনগুপ্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুজো উদ্যোক্তাও। তাঁর কথায়, “থিমের মাধ্যমে আমরা এমন সব স্থান ও ভাবনা তুলে ধরি, যেখানে যাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব বা ব্যয়বহুল। তাই এই থিম পুজোগুলিই এক অর্থে প্রকৃত সার্বজনীন পুজো—যা সবার জন্য, সবার কাছে।”
যাই হোক, থিম, অনুকরণ কিংবা অনুসরণের এই ধারাটি চলবেই — এটাই বাস্তব। তন্ত্রোক্ত মতে মহাশক্তির আরাধনা হোক বা অন্য কোনো উপাচারে পুজো — দ্বন্দ্ব থাকবেই, মতভেদও থাকবে। আর তার মাঝেই আলোয় ভেসে উঠেছে শিলিগুড়ি — উৎসবের উচ্ছ্বাসে, আনন্দের রোশনাইয়ে। তবে সেই ঝলমলে আলোর আড়ালেও যেন এক গভীর বার্তা ধ্বনিত হয় — “নিজস্বতার দীপ কখনও নিভে যেন না যায়, তার রক্ষাকর্তা কিন্তু আমরা নিজেরাই।”
Leave a Comment